তানভির সাবিক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি:
২০০৬ সালের ২৮ মে দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)। লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে প্রতিষ্ঠিত এটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয়টি মাত্র ১১ বছর না পেরুতেই ভয়াবহ সেশনজট নামক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সেশনজট আছে কিনা তা জানেন না স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ আলী আশরাফ। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন ’আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সেশনজট আছে কিনা সেটাও জানি না আমি।’
এদিকে বিভিন্ন অনুষদের একাধিক বিভাগে চলছে ভয়াবহ রকমের সেশনজট। বিভাগ ভেদে দেড় থেকে দুই বছরেরও বেশি জট রয়েছে বলে জানা যায়। এজন্য চার বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর বর্ষ মিলিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করতে যেখানে ৫ বছর লাগার কথা, সেখানে ৬-৭ বছরেও অনেক বিভাগের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার চৌকাঠ পার হতে পারছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। উচ্চশিক্ষার এ অনিশ্চয়তার কারণে হতাশা আর নানা উৎকন্ঠা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি সেশনজটে রয়েছে প্রকৌশল অনুষদ। বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগও এক থেকে দেড় বছরের জট রয়ছে।
এরমধ্যে প্রকৌশল অনুষাধীন কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীরা খুবই নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটি ২০০৮-০৯ সেশনে চালু হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একটি ব্যাচ তাদের স্নাতকোত্তর শেষ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় ব্যাচের এই শিক্ষার্থীরা (২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ) স্নাতকোত্তর শেষ করতে যাদের সময় লেগেছে প্রায় ৮ বছর। এমনিভাবে এই বিভাগের ২য় ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আছেন স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারে। তারাও প্রায় ২ বছরের জটে আছেন। এর পরবর্তী বিভাগের ৩য় ব্যাচ শিক্ষার্থীরা আছেন ১ বছর ৭ মাস, ৪র্থ ব্যাচ আছেন ৭ মাসের সেশনজটে। বাকি ব্যাচগুলোর অবস্থাও অনুরূপ।
অন্যদিকে, ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) বিভাগের শিক্ষার্থীদেরও প্রায় একই অবস্থা। বিভাগের প্রথম ব্যাচ (২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ) তারা স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন ৬ বছর ২ মাসে। এরই মধ্যে ৮ বছরেও স্নাতকোত্তর ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। ৪র্থ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা (২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ) চার বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্লাস করছেন। যেখানে তাদের মাত্র ৫ম সেমিস্টার শেষ হয়েছে। ফলে দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে জটে আছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো ৮ বছরেও স্নাতকোত্তর শেষ করতে পারবেন না বলে আশঙ্কা তাদের।
সেশনজট মুক্তি দেয়নি বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোকেও। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১ম ব্যাচ (বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম ব্যাচ) এখন স্নাতকোত্তর ২য় সেমিস্টারে। যেখানে তারা প্রায় এক বছরের জটে আছেন। এমনিভাবে বিভাগের ৪র্থ ব্যাচের (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীরা যেখানে ৮ম সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা সেখানে তারা মত্র ৬ষ্ঠ সেমিস্টারে আছেন। সেই হিসেবে তারাও প্রায় এক বছরেরও বেশি জটে আছেন।
বিজ্ঞান অনুষদের অন্যান্য বিভাগগুলো ফার্মেসি, পরিসংখ্যান ও গণিত বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও প্রায় ৫-৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত সময় ধরে সেশনজটের শিকার। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ এই তুলনায় ভাল থাকলেও একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে সেশনজট লক্ষ্য করা যায়।
এদিকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদেও সেশনজট কম নয়। অনুষদের অর্থনীতি বিভাগের ৫ম ব্যাচ (২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীরা মাত্র স্নাতকোত্তর ২য় সেমিস্টারে আছেন। তারা প্রায় ২ বছরের জটে আছেন। ৬ষ্ঠ ব্যাচের (২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীরা এখন মাত্র স্নাতক শেষ সেমিস্টারে, যেখানে তাদের স্নাতকোত্তর শেষ করার কথা। তারাও দেড় বছরের জটে আছেন। আর ৭ম ব্যাচ (২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ) যেখানে ৮ম সেমিস্টার পরীক্ষা দেওয়ার কথা সেখানে ৬ষ্ঠ সেমিস্টারই শেষ করতে পারেনি।
লোক-প্রশাসন বিভাগেও অনুরূপ চিত্র। বিভাগের ৫ম ব্যাচের (২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীরা এখনও স্নাতকোত্তর ২য় সেমিস্টারে যেখানে তারা প্রায় দেড় বছরের জটে আছেন। অপরদিকে ৭ম ব্যাচ (২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ) ৮ম সেমিস্টার শেষ করার কথা থাকলেও তারা মাত্র ৭ম সেমিস্টার দিয়েছে। পরবর্তী ব্যাচগুলোরও ঠিক একই অবস্থা বিরাজমান।
এছাড়াও কলা অনুষদের ইংরেজি বিভাগেও সেশনজটের কমতি নেই। বিভাগের ৩য় ব্যাচের (২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীরা স্নাতকোত্তর ২য় সেমিস্টার শেষ করলেও এখনও তাদের ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। তাদের জট রয়েছে ২ বছর ৫ মাসেরও বেশি। এভাবে পরবর্তী ব্যাচগুলোতেও এর প্রভাব লক্ষ করা যায়।
সেশনজটের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে অনেক শিক্ষার্থীর মাঝেই এখন চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অচিরেই তারা এই ভয়াবহ সেশন জটের কবল থেকে মুক্তি পেতে চান।
শিক্ষার্থীদের অনেকের সথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি, উপর্যুপরি ছুটি এবং বিশেষ করে অবকাঠামোগত সংকীর্ণতা এ ভয়াবহ সেশনজটের অন্যতম কারণ। অনেক বিভাগ রয়েছে যাদের ৭-৮ ব্যাচের বিপরীতে ক্লাসরুম মাত্র ২টি। এছাড়াও, গত ১ আগস্টের প্রথম প্রহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মোমবাতি প্রজ্বলনকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল্লাহ খালিদ হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল একাডেমিক কার্যক্রম ২ মাস বন্ধ রাখা হয়। অনাকাঙ্খিত দীর্ঘ এই বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১২৬ টি চুড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে যার মধ্যে স্নাতক (বিভিন্ন বর্ষের) পরীক্ষা ১০৩ টি ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা ২৩টি। যা অনেক বিভাগ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
আইসিটি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাইয়েদ মাখদুম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সংকীর্ণতা ও ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ৪ বছরের স্নাতক কোর্স আমাদেরকে ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে রানিং করতে হচ্ছে। এতে করে আমাদের কী পরিমাণ দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা চাই এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক, যাতে করে পরবর্তী ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এই দূর্ভোগ থেকে বাঁচতে পারে।’
প্রকৌশল অনুষদের আইসিটি বিভাগের চেয়ারম্যান দুলাল চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের চলমান ৮টি ব্যাচের জন্য মাত্র ২টি ক্লাসরুম ও ১টি ল্যাব রয়েছে। যা আমাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এজন্য কোন ব্যাচের সাথেই শিডিউল ঠিক রেখে যথাযথভাবে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ আলী আশরাফ বলেন, ’আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সেশনজট আছে কিনা সেটাও জানি না আমি। আর খুব একটা জট আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি সেশনজট থেকে থাকে তাহলে এ ব্যাপারে ছাত্র-শিক্ষক উভয়কে আন্তরিক হতে হবে।
প্রতিক্ষণ/এডি/শাআ